উম্মু উমারা (রা) জীবনের কিছু কথা
উম্মু উমারা (রা) । একজন মহিলা আনসারী সাহাবী।।
ভালো নাম নুসাইবা বিনতে কাব ইবনে আমর ।মদিনার বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের নাজ্জার শাখার কন্যা। আল্লাহর নবীর হিজরতের সময় তাঁর তার বয়স তখন প্রায় ৪০ বছর।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে কাব আলমাযিনির বোন তিনি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরতের পূর্বে হযরত মুসআব (রা) এর তাবলীগে মদিনার যে সকল নারী পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাদের একজন।
যখন দ্বিতীয় আকাবার বায়াত অনুষ্ঠিত হয়, ৭৫ জন সেই আকবার বয়াতে মুসলমান হন এবং তাদের মধ্যে দুইজন মহিলা ছিলেন । তাদের একজন উম্মু উমারা (রা) এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন উম্মু মানি রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু।
।
।
উম্মু উমারা (রা) জীবনীর বিশেষ কিছু ঘটনা:
১. হিজরী দ্বিতীয় সনে উহুদ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে উম্মু উমারা যোগ দেন । তিনি গিয়েছিলেন একটি পুরনো মশক সঙ্গে নিয়ে যোদ্ধাদের পানি পান করানোর উদ্দেশ্যে কিন্তু এক পর্যায়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন । তিনি যুদ্ধে চমৎকার বীরত্বের পরিচয় দেন ।শত্রুর বারটি মতান্তরে তেরোটি আঘাতে তার দেহ জর্জরিত হয় । উহুদ যুদ্ধের একপর্যায়ে শত্রু বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন জানবাজ মুজাহিদ ছাড়া আর সকলের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে ছেড়ে ময়দান থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। যে কয়েকজন মুজাহিদ নিজেদের জীবন বাজিয়ে রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নিরাপত্তা বিধান করেন তাদের মধ্যে উম্মু উমারা, তাঁর স্বামী গাযিয়্যা ও তাঁর দুই আব্দুল্লাহ ও হাবীব ও ছিলেন।
উহুদ যুদ্ধের সেই মারাত্মক পর্যায়ের বর্ণনা উন্মু 'উমারা দিয়েছেন এভাবে : “আমি দেখলাম, লোকেরা রাসূলুল্লাহকে (সা) ছেড়ে পালাচ্ছে। মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন যাদের সংখ্যা দশও হবেনা, রাসূলুল্লাহর (সা) পাশে আছে। আমি, আমার দুই ছেলে ও স্বামী রাসুলুল্লাহর (সা) পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে রক্ষা করেছি। তখন অন্য মুজাহিদরা পরাজিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। রাসূল (সা) দেখলেন আমার হাতে কোন ঢাল নেই। তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন, সে পালাচ্ছে এবং তার হাতে একটি ঢাল। তিনি তাকে বললেন, ওহে, তুমি তোমার ঢালটি যে লড়ছে এমন কারো দিকে ছুড়ে মার। সে চালটি ছুড়ে মারে এবং আমি তা হাতে তুলে নিই। সেই চাল দিয়েই আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) আড়াল করতে থাকি। সেদিন অশ্বারোহী যোদ্ধারা আমাদের সাথে খুব বাজে কাজ করেছিল। যদি তারা আমাদের মত পদাতিক হতো তাহলে আমরা শত্রুদের ক্ষতি করতে সক্ষম হতাম।”
তিনি আরো বলেছেন, কোন অশ্বারোহী আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আমাকে তরবারির আঘাত করছিল, আর আমি সে আঘাত ঢাল দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কিছুই করতে সক্ষম হয়নি। তারপর যেই না সে পিছন ফিরে যেতে উদ্যত হচ্ছিল অমনি আমি তার ঘোড়ার পিছন পায়ে তরবারির কোপ বসিয়ে দিচ্ছিলাম। ঘোড়াটি আরোহীসহ মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। তখনই রাসূল (সা) আমার ছেলেকে ডেকে বলছিলেন : 'ওহে উন্মু “উমারার ছেলে! তোমার মাকে সাহায্য কর।' সে ছুটে এসে আমাকে সাহায্য করছিল। এভাবে আমি তাকে মৃত্যুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম।
উন্মু 'উমারার ছেলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যখন মুসলিম মুজাহিদরা রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তখন আমি ও আমার মা তাঁর নিকট গিয়ে কাফিরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে শুরু করলাম। এসময় রাসূল (সা) আমাকে বললেন, তুমি উম্মু 'উমারার ছেলে? বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, শত্রুদের দিকে কিছু ছুড়ে মার। আমি আমার সামনের একটি লোকের দিকে একটি পাথর ছুড়ে মারলাম। লোকটি ছিল ঘোড়ার পিঠে। নিক্ষিপ্ত পাথরটি গিয়ে লাগলো ঘোড়ার একটি চোখে। ঘোড়াটি ছট্ফট্ করতে করতে তার আরোহীসহ মাটিতে পড়ে গেল। আর আমি লোকটির উপর পাথর ছুড়ে মারতে লাগলাম। আমার একাজ দেখে রাসূল (সা) মৃদু হাসতে থাকেন ।
উহুদ যুদ্ধ শেষ হলো। মুজাহিদরা ঘরে ফিরতে লাগলেন। রাসূল (সা) আবদুল্লাহ ইবন কা'ব মাযিনীকে পাঠিয়ে উম্মু 'উমারার অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল না হয়ে ঘরে ফিরলেন না।
উহুদ যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহর (সা) ঘোষক মদীনার মুজাহিদদেরকে 'হামরা আল আসাদ' এর দিকে বেরিয়ে পড়ার ঘোষণা দেন। উম্মু 'উমারা সেখানে যাওয়ার জন্য মাজায় কাপড় পেঁচিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু ক্ষত থেকে রক্ত ক্ষরণের কারণে সক্ষম হননি।
।
।
২. রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর ইয়ামামার অধিবাসী এবং তথাকার নেতা মুসায়লামা আল-কাজ্জাব মুরতাদ হয়ে যায়। সে ছিল একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির অত্যাচারী মানুষ। তার গোত্রে প্রায় চল্লিশ হাজার যুদ্ধ করার মত লোক ছিল। তারা সবাই তাকে সমর্থন করে। নিজের শক্তির অহমিকায় সে নিজেকে একজন নবী বলে দাবী করে এবং তার সমর্থকদের সবার নিকট থেকে জোর-জবরদস্তীভাবে স্বীকৃতি আদায় করতে থাকে। আর যারা তার নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো। হযরত উম্মু 'উমারার (রা) ছেলে হযরত হাবীব ইবন যায়দ ‘উমান থেকে মদীনায় আসার পথে মুসায়লামার হাতে বন্দী হন। সে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মুসায়লামার এহেন ঔদ্ধ্যত ও বাড়াবাড়ির কথা খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) কানে এলো। তিনি এই ধর্মদ্রোহিতার মূল উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে চারহাজার সৈন্যসহ হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদকে (রা) পাঠান। উম্মু 'উমারা (রা) তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য এটাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি খলীফার নিকট এই অভিযানে অংশগ্রহণের অনুমতি চাইলেন। খলীফা অনুমতি দিলেন। উম্মু ‘উমারা (রা) খালিদ ইবন ওয়ালীদের (রা) বাহিনীর সাথে ইয়ামামায় গেলেন। প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। বারো শো মুজাহিদ শহীদ হলেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, মুসায়লামার আট/নয় হাজার সৈন্য মারা যায়। অবশেষে মুসায়লামার হত্যার মধ্য দিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিজয় হয়।
প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। উম্মু 'উমারা (রা) সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য তাঁর ছেলের ঘাতক পাষণ্ড মুসায়লামা আল-কাজ্জাব। এক সময় তিনি একহাতে বর্শা ও অন্য হাতে তরবারি চালাতে চালাতে শত্রু বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে মুসায়লামার কাছে পৌঁছে যান। এ পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁর দেহের এগারোটি স্থান নিযা ও তরবারির আঘাতে আহত হয়। শুধু তাই নয়, একটি হাত বাহু থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে যায়। এতেও তাঁর সিদ্ধান্ত টলেনি। মোটেও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। তিনি আরো একটু এগিয়ে গেলেন। মুসায়লামাকে তাক করে তরবারির কোপ মারবেন, ঠিক এমন সময় হঠাৎ এক সাথে দুইখানি তরবারির কোপ মুসায়লামার উপর এসে পড়ে। আর সে কেটে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে। তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন, ছেলে 'আবদুল্লাহ পাশে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই কি তাকে হত্যা করেছো? আবদুল্লাহ জবাব দিলেন: একটি কোপ আমার এবং অন্যটি ওয়াহশীর। আমি বুঝতে পারছিনে কার কোপে সে নিহত হয়েছে। উম্মু উমারা (রা) দারুণ উৎফুল্ল হলেন এবং তখনই সিজদায়ে শুকর আদায় করলেন ।
হযরত উম্মু 'উমারার (রা) মৃত্যুসন সঠিকভাবে জানা যায় না। মুসায়লামার সাথে যুদ্ধ পর্যন্ত যে জীবিত ছিলেন সেটা নিশ্চিত। তবে তার পরে কতদিন জীবিত ছিলেন তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেননি।
No comments