সিয়াম বা রোজা তাৎপর্য
"হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার।" (২: ১৮৩)
রোজা বা সিয়াম সাধনা আল্লাহর অন্যতম বিধান যা শুধু ইসলামের বিধান নয়, পূর্ববর্তী ধর্মগুলোতেও এই বিধান ছিল। রোজা হলো একটি অপ্রকাশ্য ইবাদত। আর নামাজ ও হজ্ব দৃশ্যমান ইবাদত। রোজা অপ্রকাশ্য ইবাদত বলে তা দিয়ে নিজকে জাহির করা বা লোক দেখানোর সম্ভাবনা কম। রোজা মানুষের ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে। যারা একমাস ধরে দিনের বেলায় সব ধরনের খাদ্য-দ্রব্য ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে দূরে থাকে, তারা অন্যের ধন-সম্পত্তির ব্যাপারে নিজের লোভ-লালসাকে দমন করতে সক্ষমতা লাভ করে। রোজা মানুষকে উদার হতে শেখায়। যারা একমাস ধরে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করে তারা ক্ষুধার্তদের কষ্ট বুঝতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে ও সহানুভূতিশীল হয়। রোজা গুনাহ বা পাপ বর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বেশীরভাগ পাপ পেটপূজা ও ইন্দ্রিয় পরায়ণতা থেকেই জন্ম নেয়। রোজা এই দুই প্রবৃত্তিকে দমনে রেখে সমাজে দুর্নীতি ও পাপ হ্রাস করে এবং খোদাভীরুতা বা পরহেজগারিতা বাড়ায়। তাহলে এই আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে-
এক. রোজা রাখাটা ঈমানদারীর লক্ষণ। রোজা মানুষের মধ্যে খোদাভীরুতার চেতনাকে শক্তিশালী করে।
দুই. আল্লাহর বিধান পালন করা আমাদের জন্যই কল্যাণকর। এমন নয়, যে আল্লাহ আমাদের নামাজ ও রোজার মুখাপেক্ষী।
এই সূরার ১৮৪নং আয়াতে বলা হয়েছে-
أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (184)
"রোজা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য ফরজ। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময় ওই সংখ্যক রোজা রাখতে হবে। রোজা যাদের জন্য কষ্টদায়ক যেমন অতি বৃদ্ধদের জন্য, তারা অবশ্যই একজন অভাবগ্রস্তকে অন্নদান করবে। যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেশি সৎ কাজ করে, তা তার জন্য বেশী কল্যাণকর হয়। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে, তবে বুঝতে রোজা রাখাই তোমাদের জন্য বেশী কল্যাণকর। (২:১৮৪)
আল্লাহর বিধান কষ্টদায়ক কিংবা মানুষের সাধ্যাতীত নয়। বরং প্রত্যেকেই তার ক্ষমতা-সাধ্য ও শক্তি অনুযায়ী আল্লাহর বিধান পালন করতে পারে। যেমন সারা বছরের মধ্যে মাত্র এক মাস রোজা রাখা ফরজ। এই মাসে কেউ যদি সফরে বা অসুস্থ থাকে তাহলে তাকে অন্য কোন মাসে রোজা রাখতে হবে। আর যদি কোন মাসেই রোজা রাখার ক্ষমতা তার না থাকে তাহলে রোজা রেখে ক্ষুধা সহ্য করার বদলে ক্ষুধার্তকে স্মরণ করে প্রতিটি রোজার পরিবর্তে প্রতিদিন একজন গরীবকে খাবার দিতে হবে। অবশ্য এটা স্পষ্ট, রোজার কাফফারা দিতে গিয়ে কেউ যদি একজনের বেশী মানুষকে খাবার দেয়, তাহলে তা বেশী কল্যাণকর। যদি কোন মানুষ রমজান মাসের রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে সে কখনও এমনটি বলবে না যে, হায়! আমিও যদি রোজা রাখা থেকে মাফ পেতাম এবং এর পরিবর্তে গরীবকে খাওয়াতে পারতাম!
এই আয়াত থেকে আমরা যে মূল শিক্ষা পেতে পারি তাহলো- ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম এবং এটি প্রত্যেক মানুষের জন্য উপযুক্ত বিধান দিয়েছে। তাই রোজার বিধান সফরকারী, অসুস্থ এবং সুস্থদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রকম ।
১৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ (185)
"পবিত্র রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও অসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা রাখে। কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা ভ্রমেণে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ, তাই চান এবং যা তোমাদের জন্য কষ্টকর তা চান না। তাই তোমরা রোজা রাখবে অর্থাৎ রোজার সংখ্যা পূরণ করবে এবং নিজেদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা গাইবে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।" (২: ১৮৫)
আগের আয়াতে রোজা ফরজ হবার মূলনীতি এবং এর কিছু বিধান তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে রমজান মাসে রোজা রাখার কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। অবশ্য রমজান মাস রোজার চেয়েও যে জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এ মাসেই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। মূলত: রমজানের মর্যাদা ও গুরুত্ব কোরআনের জন্যই। এই মাসের শবে ক্বদরের রাত্রিতেই নাজিল হয় পবিত্র কোরআন। মাসের নাম গুলোর মধ্যে শুধু রমজান মাসের নামই কোরআনে স্থান পেয়েছে।
রামাদান শব্দের অর্থ পোড়ানো। এই মাসে রোজাদারদের পাপ বা গুনাহ পোড়ানো হয়। ইসলাম একটি সহজ সরল ধর্ম। এই ধর্মের ভিত্তি হল সুযোগ সুবিধা ও সরলতা এবং জটিলতা থেকে মুক্তি। তাই রমজান মাসে রোজা রাখা যাদের জন্য কষ্টকর ও অসম্ভব, তারা বছরের অন্য সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে ৩০টি রোজা রাখতে পারে। যদি কোন সময়ই কারো পক্ষে রোজা রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে রোজার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে নামাজের ক্ষেত্রেও যদি অজু করতে অসুবিধা থাকে, তাহলে তায়াম্মুম করার অনুমতি রয়েছে। যদি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া কষ্টকর হয়, তাহলে বসে অথবা শুয়েও নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে। তাই আল্লাহর কাছে এজন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত যে, তিনি মানুষের শক্তি ও সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন এবং কোন ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করেননি।
এই আয়াতের মূল শিক্ষা হল রমজান মাসে রোজা রেখে আমাদের আত্মাকে পাপের কালিমা থেকে মুক্ত করতে হবে এবং আমাদের অন্তরে কোরআনের প্রভাব তৈরীর জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ।
এরপরের আয়াতে অর্থাৎ ১৮৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي
No comments